Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

খাল নদী

১. পটভূমিঃ

নদটির নাম নাগর। স্থানীয় লোকেরা ডাকে ছোট নদী। নওগাঁর পতিসরে অবস্থানকালে এটিকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত শিশুতোষ কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’। সংযুক্ত খালগুলো দখলের কবলে পড়ায় রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত এই নদীও বিপন্ন হয়ে উঠছে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার মানুষের মুখে মুখে নাগরের নাম বদলে যাওয়ার ইতিবৃত্ত জানালেন ডাক বিভাগের সাবেক কর্মচারী প্রবীণ মোসলেম উদ্দিন। এলাকায় গিয়ে সম্প্রতি কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর কাছেই জানা গেল ছোট নদীর এক ‘বড় দুঃখের’ কথা।
সিংড়ার অবস্থান দেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জলাভূমি চলনবিলের বুকে। এই চলনবিল আর নাগর নদের মধ্যে যোগসূত্র ছিল হাট সিংড়া ও কাটাপুকুরিয়া খাল। গুড় ও নাগর নদের মোহনাতেই আবার মাছের অভয়ারণ্য সিংড়াদহ। নাগরের সঙ্গে যুক্ত মোট খাল চারটি।
মোসলেম উদ্দিন জানালেন, দখলে দখলে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ হাট সিংড়া-কাটাপুকুরিয়া খালের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যে খালের অর্ধেকটা হারিয়ে গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, খালের উভয় পাশে অন্তত ২০ ফুট করে দখল হয়ে গেছে।
সিংড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বর্ষীয়ান আবদুল আজিজও প্রায় একই কথা জানালেন। তিনি বললেন, তাঁর জানামতে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত খালের পুরোটা অটুট ছিল। এর বছর পাঁচেক পর খালের মুখে নদীতে চর পড়ায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় দখল। খালগুলো ভরাট ও দখল হওয়ায় নদীরও ক্ষতি হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. হানিফ শেখ বলেন, নদীর বয়ে আনা পলি খাল দিয়েই চলনবিলে গিয়ে পড়ে। কিন্তু বাঁধ, জলকপাট (স্লুইসগেট) ও দখলের কারণে খালগুলো নদীর পলি বইতে পারছে না। এতে এলাকার নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিলের মধ্যে নির্মিত অপরিকল্পিত সড়ক, সেতু ও কালভার্ট সমস্যা বাড়িয়েছে।
চলনবিলের বুক চিরে বয়ে গেছে আত্রাই, গুড়, গুমানী, বেশানী, বড়াল, ভাদাই, নাগরসহ ১৪টির বেশি নদ-নদী। এ ছাড়া আছে বেশ কিছু খাল।
হাট সিংড়া-কাটাপুকুরিয়া মৌজার খালটি যেখানে নদীর সঙ্গে মিলেছে, বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে চর পড়ে যায়। আবেদ তালুকদার নামের এক ব্যক্তি বছর দশেক আগে সেখানে গড়ে তোলেন তালুকদার মার্কেট। বর্তমানে তাঁর ছেলেরা তা ভোগদখল করছেন। জানতে চাওয়া হলে আবেদের ছেলে আবদুল লতিফ তালুকদার বলেন, তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে এই জমির মালিক। এখানে আদৌ কোনো খাল ছিল কি না, তা তাঁর জানা নেই।
সিংড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেহানুল ইসলাম বলেন, সাবেক নকশায় খাল ও নাগর নদের স্পষ্ট সংযোগ দেখা যায়। বর্তমানে সেটা দেখা যায় না।
খালের অন্য প্রান্ত বছর দশেক আগেও চলনবিলের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে এলাকাবাসী জানালেন। তখন প্রথমে সেখানে এলাকাবাসী বালুয়া-বাসুয়া ঈদগাহ মাঠ তৈরি করেন। পরে বাড়ি বানিয়েছেন আবদুল প্রামাণিক, ইসমাইল প্রামাণিক ও রাজা প্রামাণিক।
আবদুল প্রামাণিক দাবি করেন, খাল ও বিলের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই জমি তাঁর বাবা রিয়াজউদ্দিন প্রামাণিকের ১৯৬২ ও ১৯৭৪ সালের রেকর্ড করা সম্পত্তি। সেখানে খাল ছিল, এ তথ্য উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাঙনে আমাদের জমি খালে পড়ে গিয়েছিল। পরে খাল ভরাট হয়ে গেলে আমরা বাড়ি করিচ্ছি।’
বালুয়া-বাসুয়া ঈদগাহ কমিটির সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হুসেন বলেন, ‘খালের সঙ্গে নদীর মুখ বন্ধ হয়ে খাল মরে গিয়েছিল। তখন আমরা এ প্রান্তে এলাকাবাসী মিলে ঈদগাহ মাঠ করি।’
সিংড়া সদরের আরেক খাল নাড়ির বাড়ি জোলা দখল করে ধান চাষ করা হচ্ছে। খালের উত্তর দমদমা গ্রামের অংশে গিয়ে এ প্রতিবেদক দেখেন আবদুল জাফর, হাছেন আলীসহ কয়েকজন পাশের জমি থেকে মাটি কেটে খালে বাঁধ দিচ্ছেন। ‘পানি বন্ধ করছেন কেন’—জিজ্ঞেস করলে হাছেন আলী বললেন, ‘তা না হলে ধান ডুবি যাবি যে!’
‘খালে ধান লাগিয়েছেন কেন’—জিজ্ঞেস করতেই হাছেন আলীর ঝটপট উত্তর, ‘এক লাখ ২০ হাজার টাকায় খাল লিজ লিয়া ধান লাগাইছি। ধান ডুবি গ্যালে ট্যাকা উঠপি কী করি!’ তিনি বললেন, দমদমার তিন মসজিদকে টাকা দিয়েছেন। আর মসজিদকে টাকা নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ।
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সাংসদ হচ্ছেন তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
হাছেনের উল্লেখ করা তিন মসজিদের একটি দমদমা স্লুইসগেট জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ওই খাল ও খালের পাড়ে ৪৫ বিঘা খাসজমি আছে। এর মধ্যে ১০ বিঘা খালের মধ্যে। এরশাদ আমল থেকে আমরা মসজিদের উন্নয়নের জন্য ওই জমি ভূমি অফিস থেকে লিজ নিয়ে থাকি। বর্তমানে সরকার লিজ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এমপি সাহেব সবাইকে বলে দিয়েছেন। কেউ এ ব্যাপারে আপত্তি করেন না।’
জানতে চাইলে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ নিশ্চয়ই আমার নাম ভাঙিয়ে এই কাণ্ড করছে। মাত্র বছর দুয়েক আগে অনেক চেষ্টা-তদবির করে খালটি খনন করিয়েছি আমি। এর ফলে দমদমা থেকে চৌগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত খালের দুই পাশের কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে হয় না।’
জুনাইদ আহেমদ বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানালেন। হাট সিংড়া ও কাটাপুকুরিয়া মৌজার খাল সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, ওই খাল দখল ও দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি খালটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুই পাশে চলাচলের পথ (ওয়াকওয়ে) তৈরি করার জন্য একটি প্রকল্প প্রণয়নের কথাও জানালেন। জানা গেল, সিংড়া উপজেলা পরিষদ প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছে।